শিক্ষার সুযোগ চায় মান্থারা
বছর পার বছর ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেও চিন্তা করেনি রোকেয়া বেগম। তিনি বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট ফেরিঘাট সংলগ্ন মান্তা সম্প্রদায়ের সরদার জসিম সরদারের স্ত্রী। নিজে কোনোভাবে জীবন পার করলেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
জসিম সরদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, একটি স্কুলের অভাবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে পারছেন না। এই ফেরিঘাট সংলগ্ন মান্তা সম্প্রদায়ের দেড়শ পরিবার। এ দেড়শ পরিবারে আড়াইশো ছেলেমেয়েসহ অন্তত ৭৫০ জনের বসবাস। এদের কারোর মধ্যে নেই ন্যূনতম শিক্ষার ছোঁয়া। জন্মের পর থেকে একটু বড় হয়েই শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের পেশাকেই বেছে নিচ্ছে। আর তাদের মূল পেশাই হচ্ছে নদীতে ভেসে ভেসে মাছ শিকার করা। শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মান্তা সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা ৫-৬ বছর বয়স থেকেই তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে নেমে পড়ে নদীতে মাছ ধরতে। সেখানে থেকেই তারা ধীরে ধীরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। এরপর আর শিক্ষার কোনো সুযোগ থাকে না তাদের।
সদর উপজেলার বুখাই নগর এলাকার মান্তা সম্প্রদায়ের হালিমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যেই বয়সে মোগো পোলা-মাইয়ার হাতে বই-খাতা-কলম থাকার কথা, সেই বয়সে মোরা মাছ ধরার জাল তুইল্লা দেই। এছাড়া আর মোগো কোনো উপায় নাই। কারণ মোরা মাইয়া পোলা স্কুলে লেহাপড়া হড়াইতে (করাতে) পারি না। মোগো পোলা মাইয়া স্কুলে দেলে ওগো লগে কূলের (পাড়ের) পোলা মাইয়ারা পড়তে চায় না। মোগো পোলাপাইনগো কূলের গুড়াগাড়ায় (ছেলেমেয়েরা) চেতায় (উত্ত্যক্ত) যে তোরা মান্তার মাইয়া পোলা। এসব হোনার পর আর মোগো পোলাপাইন স্কুলে যাইতে চায় না। হেরপরও অনেক জোর হইররা বুঝাইয়া স্কুলে দেছেলাম, কিন্তু কূলের গুড়াগাড়ায় মোগো পোলাপাইন ধইররা মারে। হেইয়ার লইগ্গা আর পোলা মাইয়ারা স্কুলে যাইতে চায় না।
তিনি বলেন, ‘হুদা গুড়াগাড়া স্কুল পাডানো লইয়া সমস্যা না। মোগো মধ্যে কেউ
যদি মরে হেরে মাডি দেওয়া লইয়া মোগো বিপদে পড়তে হয়। কূলে কেউ মোগো একটু
মাডি দেওয়ার জায়গাও দেতে চায় না। অনেক কষ্ট হইরা এর-ওর হাতে-পায়ে
ধইররা মাডি দেওন লাগে। এর আগেতো কেউ মরলে কেলা গাছের (কলাগাছ) ভোর খিলাইয়া
(ভেলা বানিয়ে) ভাসাইয়া দিতাম। এখন আর হে (তা) পারি না। ডাঙ্গায়
মেম্বার-চেয়ারম্যানগো হাতে-পায়ে ধইররা মাডি দেই।
হালিমা বলেন, ‘অথচ দেহেন মোরা হগলডি (আমরা সবাই) কিন্তু এহানের ভোটার। ভোডের সময় মেম্বার-চেয়ারম্যানরা আইয়া মোগো লগে মিডা মিডা কথা কয়। ভোডের পর আর কেউর খবর থাহে না। মোরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই যেন মোগো পোলা মাইয়াগো লইগ্গা একটা আলাদা স্কুল কইররা দেয়। এছাড়া মোরা মরলে যেন একটু কূলে মাডি (মাটি) পাই। হেই জন্য একটা গোরস্তানের দাবি জানাই। মোরা একটা স্বাভাবিক জীবন চাই।’ একই কথা বলেন লাহারহাট ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকার মান্তা সম্প্রদায়ের সদস্যরা।
সাত বছরের শিশু রুমানা বলে, ‘লেহাপড়া করতে চাই
কিন্তু এই এলাকার আশপাশে কোনো স্কুল নাই। তাই স্কুলে যাইতে পারি না।
বাপ-মায় দূরের স্কুলে পাডাইতে (পাঠাতে) চায় না।’ আরেক শিশু লাকি (৯) বলে,
‘স্কুলে ভর্তি হইছেলাম কিন্তু মোগো লগে কেউ পড়তে চায় না। মোগো পাশে কেউ
বইতে চায় না। আর স্কুলের বড় তায় মোগো ধইররা মারে, হেইয়ার লইগ্গা এহন আর
স্কুলে যাই না। বাপে-মার লগে মাছ ধরি।
সতর্ক উপজেলার তালতলী ভাঙার পাড়
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুরা সারাদিন খেলাধুলা ও
এদিক সেদিক ঘুরেফিরে দিন পার করছে। কেউ কেউ নদীতে লাফিয়ে পড়ে গোসল করছে,
আবার কেউ নৌকা নিয়ে নদীতে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। এভাবেই চলছে তাদের
শৈশবকাল।
বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গীবাড়ীয়া ইউনিয়নের লাহারহাট, চরমোনাই
ইউনিয়নের বুখাইনগর, চরকাউয়া চরবাড়িয়া ও শায়েস্তাবাদ এলাকায় নদীর পাড়ে
অবস্থান করছে এই মান্তা সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এই সম্প্রদায়ের একমাত্র পেশা
মৎস্য শিকার। এদের স্বাস্থ্য সেবা নেই বললেই চলে। নেই সুপেয় পানির
ব্যবস্থা। পয়ঃনিষ্কাশন বা স্যানিটেশন বলতে কিছুই নেই তাদের। তাদের নেই
ভুমি, নেই জাতীয় পরিচয়পত্র, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারি কোন ধরনের
সুযোগ ও সুবিধা। তাদের কাছে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় যে সকল তথ্য থাকা দরকার
তাও তারা জানে না। এই সকল তথ্য ও সেবা কোথায় কিভাবে পাওয়া যায় সেটা জানার
প্রয়োজন থাকা সত্তেও তারা তা পায় না।
মান্তা সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা
বেসরকারি সংস্থা সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাশেদ খান
বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায় নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। এরা আমাদের সমাজে
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এদের বাধ দিয়ে সামনে আগানো যাবে না। তাই তাদের নিয়ে
আমাদের কাজ করতে হবে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে এদের বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা শুধু ”নারী মৎস্যজীবি বিশেষভাবে মান্থা নারীদের তথ্য সমৃদ্ধি ও
অন্তর্ভুক্তি” প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সমৃদ্ধি ও
সুবিধাগুলো পাওয়ার বিষয়ে অর্ন্তভূক্তি করার চেষ্টা করছি।
এ ব্যাপারে
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ইকবাল হাসান বলেন, বরিশাল সদর
উপজেলায় প্রায় আড়াইশ থেকে তিনশো মান্থা কমিউনিটির লোকজন বসবাস করে। এরা
নদীতেই থাকে নদীতে বসবাস করে। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস মাছ শিকার। তাদের
লাইফটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। তারা যেন জেলে কার্ড পায় এবিষয়ে আমরা কাজ করছি।
পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার বিষয়েও আমরা কাজ করছি। পর্যাক্রমে তাদের
আশ্রয়নের ব্যবস্থা করা হবে। এবং সেই আশ্রয়নের পাশেই শিশুদের জন্য প্রাথমিক
বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।