শিরোনামঃ

নিষেধাজ্ঞা নয়, জেলেদের নিরাপদ  টেকসই বিকল্প জীবিকার দাবীতে সেমিনার



 বরিশাল 

মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে জীবিকা সুরক্ষায় ন্যায্য সহায়তা ও বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে বরিশালে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। বরিশাল প্রেসক্লাব মিলনায়তনে কোস্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন জেলা নারী ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মেহেরুন নাহার মুন্নি। কোস্ট ফাউন্ডেশনের জেলা সমন্বয়কারী মোঃ জহিরুল ইসলামের মূল প্রতিবেদনের উপর আলোচনা করেন কোস্টগাডের চীফ পেটি অফিসার মাইনুদ্দিন, সমাজ সেবা কর্মকর্তা ইসমত আরা, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবি সমিতির সভাপতি ইসরাইল পন্ডিত, কোস্ট ফাউন্ডেশনের উপ-নির্বাহী পরিচালক সনত কুমার ভৌমিক, মান্দা জেলে জনগোষ্ঠী সর্দার মোঃ জসিম উদ্দিন প্রমূখ। 

বক্তারা জানান, বরিশালের জেলেরা নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলা করেন, বিশেষ করে অবরোধের সময় এ অঞ্চলের জেলেরা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে, সরকারীভাবে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা একদিকে অপ্রতৃল যা দিয়ে তাদের ৩০% খরচ মেটানো সম্ভব হয়না, যা দিয়ে তাদের সংসার চলেনা আবার সেই বরাদ্দ সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে না পৌঁছানোর কারণে খুব একটা কাজেও আসেনা। জেলেদের বিকল্প আয়ের তেমন কোনো সুযোগ না থাকার কারণে তাদের পরিবারে নারী সদস্যদের ওপর এই চাপ আরও গভীর হয়। আয় কমে গেলে পরিবারের মধ্যে ঘরোয়া সহিংসতার হার বেড়ে যায়, বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞার সময়ে। কোস্ট ফাঊন্ডেশনের মাঠপর্যায়ের জরিপ অনুযায়ী, বরিশালের নদী উপকূলবর্তী এলাকায় ৩৮ শতাংশ নারী জেলে পরিবারের নারী সদস্য নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক সংকট ও খাদ্য ঘাটতির ফল।

বরিশাল জেলার নদীভিত্তিক মান্দা বা ভাসমান জেলে সম্প্রদায় হলো সবচেয়ে বঞ্চিত একটি গোষ্ঠী। তাদের কোনো স্থায়ী বসতি বা জমি নেই, অধিকাংশই নদীতে নৌকায় বসবাস করে। সরকারি তালিকায় না থাকায় তারা খাদ্য সহায়তা, জেলে কার্ড বা সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা কিছুই পায় না।


মোঃ জহিরুল ইসলাম, জেলা সমন্বয়কারী, কোস্ট ফাউন্ডেশন তার কী নোট উপস্থাপনায় বলেন, বরিশালের জেলেদের ৮৫% নদী বা মোহনা-নির্ভর, যাদের অধিকাংশই ছোট টলার বা কাঠের নৌকায় মাছ ধরেন। কোস্ট ফাঊন্ডেশনের এর ২০২৫ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মাসিক গড় আয় নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ১৫,০০০ টাকা থেকে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৩,০০০-৪,০০০ টাকায়। পাশাপাশি সরকার যে চাল সহায়তা দেয়, তা পরিবারপ্রতি গড়ে মাত্র ১০-১২ দিন চলে। ফলে জেলেরা বাধ্য হয় দাদনদার বা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে।  এছাড়া নিষেধাজ্ঞার সময় প্রায় ৬০% জেলে দিনমজুরির কাজে (রিকশা, ভ্যান চালানো, কৃষিশ্রমিক, নৌকা মেরামত ইত্যাদি) যুক্ত হন, ২৫% জেলে ঋণের ওপর নির্ভর করেন, এবং ১৫% জেলে জীবিকার তাগিদে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরেন। এতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়লেও জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এই প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না।


সনত কুমার ভৌমিক, উপ-নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ফাউন্ডেশন বলেন,সরকারকে অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার আগেই প্রতিটি নিবন্ধিত জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি চাল ও ৮ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে এবং অন্তত একজন সদস্যের জন্য বিকল্প আয়ভিত্তিক কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, যুব মৎস্যজীবীদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ছোট নৌকায় (খাল ও নদীতে) বসবাসকারী মান্দা সম্প্রদায়কে জেলে কার্ড প্রদান ও নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাখার আহবান জানান।

মোঃ জসিম উদ্দিন-সর্দার মান্দা জেলে জনগোষ্ঠী বলেন “জাতীয় পরিচয় হিসেবে আমাদের অনেকের এখনো জাতীয় আইডি কার্ড প্রদান করা হয় নাই, কোস্ট গার্ড এর স্পীডবোট গেলে ঢেউয়ে নৌকায় থাকা রান্না খাবার পড়ে যায়। এছাড়াও মান্দার জেলেদের থাকার জন্য কোনো জায়গা নাই এমনকি মৃত্যুর পরে তাদের কবর দেওয়ার জন্য কোনো কবরস্থান নাই ”

ইসরাইল পন্ডিত- সভাপতি, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবি সমিতি বলেন “ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন প্রতিনিধি জেলে জনগোষ্ঠীর তালিকা করেন সেক্ষেত্রে অনেকসময় প্রকৃত জেলে থাকেন না তাই জেলে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই তালিকা করলে প্রকৃত জেলে জনগোষ্ঠী সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হবেন।”

ইসমত আরা- সমাজ সেবা কর্মকর্তা বলেন “বিকল্প কাজের ব্যবস্থা শুধু অবরোধকালীন সময়ে না যখন তাদের কাজ থাকবে না তখনকার সময়ের জন্য বিকল্প কাজ দরকার সেজন্য বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা, এছাড়া সুদমুক্ত ঋন এর ব্যবস্থা করা, নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে সময়মত চাল সরবরাহ করা জরুরী। 

মেহেরুন নাহার মুন্নি উপ-পরিচালক, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বলেন “জেলে সম্প্রদায় এর মধ্যে নারী জেলেরাও কাজ করছেন তার সাথে তাদের সন্তানরাও থাকেন তারা নৌকার ভিতরে মানবেতর  জীবনযাপন করছেন যাহাতে তাদের জীবন ঝুকি থাকে এক্ষেত্রে অনেকসময় তারা ঝড়, বৃষ্টিতে তাদের নৌকাডুবির শঙ্কা থাকে, তাই তাদের নিরপত্তা খুবই জরুরী। 

মাইনুদ্দিন- চীফ পেটি অফিসার কোস্টগার্ড বলেন, অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন অবরোধ কালীন সময়ে প্রতিটি মা ইলিশ একবারে প্রায় ১০ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ ডিম পাড়ে তাই এই সময়ে মাছ না ধরার আহ্বান এবং এই সাময়িক অসুবিধা কালীন সময়ে আমরা বৃহৎ ভাবে উপকৃত হবো অধিক মাছ পেয়ে, তাই সকলের উচিত জেলেদের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করে, তাদের খাদ্য ও নিরাপত্তা দেয়া যাতে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি পায়। 

সেমিনারে উপস্থিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান “গত পাঁচ বছরে ইলিশ আহরণ ৩.৪% হ্রাস পেয়েছে। নারী ও যুবকদের আয়ভিত্তিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা গেলে পরিবারের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সময়মতো খাদ্য ও অর্থ বিতরণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক আয়ভিত্তিক কর্মসংস্থান, স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা এবং প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের সরকারি কর্মসূচিতে ন্যায্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হোক, যাতে কোনো মৎস্যজীবী পরিবার ক্ষুধার মুখে না পড়ে।

এই বিভাগের আরো খবর

অনলাইন ভোট

খবর সরাসরি ইনবক্সে পেতে চান?